লুই পাস্তুর (Louis Pasteur)
লুই পাস্তুর (Louis Pasteur)
মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব যে জলে রাজত্ব করে চলছে, অণূবী্ক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারক অ্যান্টনি ভন লিউয়েন হুক তা অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের সময়ই উদঘাটন করে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর ব্যাপক সাড়া ফেলে । জল ছাড়া অন্য কোথাও এসব জীবের অস্ত্বিত্ব আছে কি না, তা জানার জন্য অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেন। লিউয়েনহুকের আবিষ্কৃত অণূবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমেই শুরু হয় গবেষণা। এ বিষয়ে যিনি কালজয়ী খ্যাতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি ফ্রান্সের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) । পাস্তুরই সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন, জীবাণূরা নিজে থেকেই জন্মায় না। অর্থাৎ এদেরও পূর্বপুরুষ আছে। অপরুদিকে কেবল জল নয়, মাটি আর বাতাসেও এরা ঘুরে বেড়ায়। এক কথায় জল-স্থল-আকাশের সর্বত্রই বিচরণ করছে ওরা। মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা প্রভৃতি অধিকাংশ রোগের মূলেও আছে এদের অনেকেরই প্রত্যক্ষ ভূমিকা।
প্রথম থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর জীবাণূদের নিয়েই গবেষণা করে গেছেন। তার গবেষণা শুরু হয়েছিল ফ্রান্সের এক বিশেষ সমস্যাকে কেন্দ্র করে। প্রথম জীবনে পাস্তুর যখন অধ্যাপনা শুরু করেন, সেই সময় ফ্রান্সের গুটিপোকার মড়ক দেখা দেয়। গুটিপোকার চাষের মাধ্যমে রেশম উৎপাদন ছিল তখনকার ফ্রান্সের একটি জাতীয় ব্যবসা। যখনই মড়ক ভয়ানকভাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন চাষিরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেন। সরকার থেকে সাধারণ মানুষ সবাই চিন্তিত হলেন। তখন এই মড়কের কারণ অনুসন্ধানের ভার পড়ে লুই পাস্তুরের উপর। লুই পাস্তুরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে জানা যায়, গুটিপোকার মড়কের মূলে আছে এক ধরনের অদৃশ্য জীবাণু। তিনি এই জীবাণু শনাক্ত করেন এবং এ জীবাণু ধ্বংসের উপায়ও উদ্ধাবন করেন।
পরবর্তী পর্যায়ে পাস্তুর আবিষ্কার করেন কোনো কিছু ঢুকে যাওয়া বা গেঁজে ওঠার মূলে আছে সেই অদৃশ্য জীবাণুদের হাত। তিনি প্রমাণ করেন দুধ টক দই হয়ে যাওয়া, দইয়ে ছাতা পড়া, অ্যালকোহল ও মদ প্রভৃতি নষ্ট হয়ে যাও প্রভৃতির মূলে আছে জীবাণূদের কলোনি গঠন।
পাস্তুরের গবেষণাগুলি চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি যুগান্তকারী অবদান। তিনিই প্রথম দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন , জীবিত বা মৃত কোনো রোগের জীবাণু যদি সীমিতভাবে দেহে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তবে দেহ সেই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক ক্ষমতা লাভ করবে। আর এর ফলে ভবিষ্যতে সেই জীবাণুর আক্রমণ সম্পূর্ণরুপে প্রতিহত করবে।
মহামতি এডওয়ার্ড জেনার এই সত্যটি বসন্ত রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু সেই সত্যটিকে তখনও কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না। পাস্তুরের ঘোষণা শুনে জীববিজ্ঞানীরা সেদিন হেসেছিলেন। রোগ-জীবানু দেহে প্রবেশ করালে রোগই হবে, রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা লাভ করা মোটেও সম্ভব নয়। তাই কেউ মেনে নিতে পারেনি পাস্তুরের কথা। বরং বিদ্রুপই করেছিলেন পাস্তুরকে।
পাস্তুর কিন্তু সহজে হার মানেননি।
তিনি সবার সামনে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। অবিশ্বাসীরা এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন।
নির্দিষ্ট দিনে পাস্তুর ৫০ টি ভেড়া সংগ্রহ করে তাদের ২৫ টির দেহে মৃদু অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ( ক্ষতিকর নয় এমন জীবাণু) প্রবেশ করিয়ে দিলেন, বাকি ২৫ টি আগের মতোই রেখে দিলেন।
কয়েক দিন পরে ৫০ টি ভেড়ার প্রত্যেকটির দেহে সমপরিমাণ তীব্র অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু ইনজেকশন দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। এবার দেখা গেলো, যে ২৫ টি ভেড়াকে আগেই টিকা দেওয়া হয়েছিলো তাদের কেউ রোগাক্রান্ত হলো না। কিন্তু টিকা না দেওয়া ভেড়ার সবগুলোই সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো।
প্রকৃতপক্ষে ঐ পরীক্ষা করে দেখানোর পর চিকিৎসা জগতে টিকাদানের পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। কেবল মানুষ নয়, টিকা দেয়ার ব্যবস্থা হওয়াতে গবাদিপশু এবং গৃহপালিত পাখিরাও সংক্রামক ব্যাধির কবলমুক্ত হয়। এই আবিষ্কার সারা বিশ্বেই যুগান্তকারী অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
লুই পাস্তুরের আর একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার জলাতঙ্ক রোগের সিরাম। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন, ক্ষ্যাপা কুকুর, নেকড়ে, শেয়াল, বিড়াল প্রভৃতি প্রাণীর লালায় এক ধরনের উগ্র রোগ জীবাণু বাসা বাধে। সেসব প্রাণী অপর সুস্থ প্রাণীকে কামড়ালে সেই রোগের জীবাণু সুস্থ দেহে প্রবেশ করে এবং এর প্রভাবে জলাতঙ্ক রোগ হয়। ঐ রোগ অত্যন্ত মারাত্মক এবং এর কবল থেকে কেউ রক্ষা পায় না।
পাস্তুর ক্ষ্যাপা কুকুরের লালা থেকেই এক ধরনের সিরাম প্রস্তুত করেন। এটি জলাতঙ্ক রোগের সর্বপ্রথম টিকা।
লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকার প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন জোসেফ লিস্টার নামে একটি বালকের উপর। বালকটির জলাতঙ্ক রোগ না হওয়ায় সারা পৃথিবী জুড়ে ধন্য ধন্য রব পড়ে গিয়েছিলো।
পাস্তুরের আবিষ্কারের সত্যিই কোনো তুলনা হয় না। তিনি মানুষ, জীব-জন্তু ও গাছ- পালা সবাইকে নানা ধরনের ব্যাধির কবল থেকে মুক্ত করার উপায় উদ্ভাবন করে গেছেন। মুরগিদের টিকাদানের পদ্ধতি তারই আবিষ্কার এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে গাছপালাকে রক্ষা করতে কীটনাশক প্রয়োগের সিদ্ধান্ত তারই। তাই পৃথিবীর সর্বদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানবহিতৈষীদের মধ্যে পাস্তুর অন্যতম।
No comments