অধ্যায় -৬ : চুম্বক
চুম্বক ও চুম্বকত্ব
যে পদার্থের আকর্ষণীয় ও দিকদর্শী ধর্ম আছে এবং মুক্ত অবস্থায় সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলে উত্তর ও দক্ষিণ মুখ করে থাকে তাকে চুম্বক বলে।
তুরস্কের ম্যাগনেশিয়া নামক গ্রামে ধূসর কালো রঙের এক ধরনের খনিজ আকরিক পাওয়া যায় যার মধ্যে চুম্বকের এই ধর্মগুলো বিদ্যমান ছিল। উক্ত স্থানের নাম অনুসারে ঐ আকরিকের নামকরণ করা হয় ম্যাগনেটাইট। এ ম্যাগনেটাইট হতে চুম্বকের ইংরেজি নাম ম্যাগনেটাইট হয়েছে।
চুম্বকের ধর্ম
চুম্বকের মূল চারটি ধর্ম বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
যথা :-
ক) আকর্ষণী ধর্ম : যে ধর্মের কারণে চুম্বক অনেক পদার্থকে আকর্ষণ করে তাকে চুম্বকের আকর্ষণী ধর্ম। চুম্বক লৌহ বা লোহা জাতীয় পদার্থকে আকর্ষণ করে। এক খন্ড চুম্বককে লৌহ চূর্ণের মধ্যে ডুবালে চুম্বকের সাথে লৌহ চূর্ণ লেগে যায়। এর অর্থ চুম্বক লৌহ চূর্ণকে আকর্ষণ করে।
খ) দিকদর্শী ধর্ম : চুম্বক যে ধর্মের দ্বারা দিক নির্দেশ করতে পারে তাকে চুম্বকের দিকদর্শী ধর্ম বলে।
একটি চুম্বককে পাকহীন সুতার সাহায্যে মুক্তভাবে ঝুলিয়ে দিলে কয়েকবার দোলার পর অবশেষে মোটামুটি ভৌগোলিক ভাবে উত্তর ও দক্ষিণ বরাবর মুখ করে স্থির থাকে। চুম্বকটি এভাবে উত্তর ও দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে।
গ) বিপরীত ধর্ম দুটি প্রান্ত : প্রত্যেক চুম্বকের একটি উত্তর মেরু ও একটি দক্ষিণ মেরু প্রান্ত থাকে। দুইটি চুম্বকের সমধর্মী দুটি প্রান্ত পরস্পর কাছাকাছি আনলে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত ধর্মী দুটি প্রান্ত কাছাকাছি আনলে আকর্ষণ করে।
ঘ) চুম্বকন ধর্ম : চুম্বক দ্বারা লৌহ দন্ডকে ঘর্ষণ করলে লৌহ দন্ডটি চুম্বকে পরিণত হয়। চুম্বকের এ ধরনের ধর্মকে চুম্বকন ধর্ম বলে।
চুম্বকের শ্রেণীবিভাগ
চুম্বক প্রধানত দুই প্রকার।যথা :
ক) প্রাকৃতিক চুম্বক : যে চুম্বক প্রকৃতিতে অর্থাৎ পাহাড়, পর্বত ও খনিতে পাওয়া যায় তাকে প্রাকৃতিক চুম্বক বলে। প্রাকৃতিক চুম্বকের আকর্ষণী ও দিকদর্শী ধর্ম খুব কম। এ কারণে যন্ত্রপাতি তৈরিতে এ চুম্বকের ব্যবহার খুবই কম।
খ) কৃত্রিম চুম্বক : পরিক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে যে চুম্বক তৈরি করা হয় তাকে কৃত্রিম চুম্বক বলে।এ চুম্বকের মেরু শক্তি অনেক বেশি। কৃত্রিম চুম্বক যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
কৃত্রিম চুম্বকের প্রকারভেদ
কৃত্রিম চুম্বক আবার দুই ধরনের। যথা স্থায়ী চুম্বক ও অস্থায়ী চুম্বক।
ক) স্থায়ী চুম্বক : যে চুম্বক পদার্থ কে চুম্বকে পরিণত করার পর চুম্বকত্ব শক্তিকে অপসারণ করলে পদার্থটির চুম্বকত্ব বজায় তাকে স্থায়ী চুম্বক বলে।
খ) কৃত্রিম চুম্বক : যে চুম্বক পদার্থ কে চুম্বকে পরিণত করার পর চুম্বকত্ব শক্তিকে অপসারণ করলে পদার্থটির চুম্বকত নষ্ট হয়ে যায় তাকে কৃত্রিম চুম্বক বলে।
যথা : কাঁচা লোহার চুম্বক।
চৌম্বক শক্তি
চুম্বক কিছু বস্তুকে আকর্ষণ করে।
তড়িৎ চুম্বক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভারি পদার্থ উত্তলন করা হয়।তড়িৎ চুম্বক শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
বিদ্যুৎ ও চুম্বকের ঘটনা
চুম্বক যে সকল পদার্থকে আকর্ষণ করে তাদেরকে চৌম্বক পদার্থ বলা হয়। লোহা, কোবাল্ড, ইস্পাত ইত্যাদি চৌম্বক পদার্থ।
কপার, অ্যালুমিনিয়াম, সিলভার ,পিতল অচুম্বক পদার্থ।
বিদ্যুতের সাহায্যে পেরেককে চুম্বকে রুপান্তর
পেরেককে তারে পেঁচিয়ে তারের দুই প্রান্ত একটি ব্যাটারীর (🔋) দুই প্রান্তে সংযোগ দিলে পেরেকটি চুম্বকের মত আচরণ করে।
প্রস্তুতিপ্রণালী অনুযায়ী কৃত্রিম চুম্বক আবার ছয় প্রকার। যথাঃ-
১. দন্ড চুম্বক: এটি ইস্পাতের তৈরি আয়তাকারবিশিষ্ট একটি স্থায়ী চুম্বক। যেহেতু এর আকার লম্বাটে, সেজন্য একে দন্ড চুম্বক বলা হয়।
২. অশ্ব – ক্ষুরাকৃতি চুম্বক : যে সকল চুম্বকের আকার দেখতে ঘোড়ার ক্ষুরের মতো বা ‘ট’ আকৃতির হয়, তাকে অশ্ব- ক্ষুরাকৃতি চুম্বক বলে। এই চুম্বকের মেরুদ্বয় কাছাকাছি থাকায় চুম্বক শক্তি বেশি হয়। বিভিন্ন বৈদ্যুতিক পরিমাপক যন্ত্রে এ চুম্বক ব্যবহার করা হয়।
৩. শলাকা চুম্বক : যে চুম্বকের মধ্যভাগ মোটা এবং দুপ্রান্ত সূচের মতো সরু শলাকারবিশিষ্ট হয়, তাকে শলাকা চুম্বক বলে। এগুলো সাধারণত দিক দর্শক যন্ত্রে ও বৈদ্যুতিক মিটার যথা: ম্যাগনেটোমিটার, ট্যানজেন্ট গ্যালভানোমিটার ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।
৪. রিং চুম্বক: যে চুম্বকের আকার দেখতে আংটির মতো গোলাকার, তাকে রিং চুম্বক বলে।
৫. চোঙ্গাকৃতি চুম্বক: যে চুম্বকের আকার দেখতে সিলিন্ড্রিক্যাল বা চোঙ্গাকৃতির মতো, তাকে চোঙ্গাকৃতি চুম্বক বলে।
৬. শেল চুম্বক: পাত আকারের যে চুম্বকের এক পৃষ্ঠে উত্তর মেরু এবং অপর পৃষ্ঠে দক্ষিণ মেরু বিদ্যমান তাকে শেল চুম্বক বলে।
চুম্বকত্ব
যে পদার্থের আকর্ষণী ও দিকদর্শী ধর্ম বিদ্যমান আছে এবং মুক্ত অবস্থায় সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মুখ করে থাকে, তাকে চুম্বক বলে। আর চুম্বকীয় পদার্থে আকর্ষণী ও দিকদর্শী ধর্ম বিদ্যমান থাকে। চুম্বকের শক্তিকেই চুম্বকত্ব বলে। সুতরাং যে ধর্ম বা বৈশিষ্টের জন্য চুম্বকে আকর্ষণী বা দিক নির্দেশ করে থাকে, সেই ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যকে চুম্বকত্ব বলে।
চুম্বক ক্ষেত্র
কোনো চুম্বকের চারদিকে যে স্থান জুড়ে এর প্রভাব বিস্তৃত থাকে অর্থাৎ আর্কষণজনিত অথবা বিকর্ষণজনিত প্রভাব হতে পারে সে অঞ্চলকে চু্ম্বক ক্ষেত্র বলে। গাণিতিক নিয়মে চুম্বকের এ প্রভাব অর্থাৎ চুম্বকের চুম্বক ক্ষেত্র অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নির্দিষ্ট চুম্বক ক্ষেত্র জুড়ে এটি প্রভাব বিস্তার করে।
চুম্বকীয়করণের বৈদ্যুতিক পদ্ধতি
একটি কাচা লোহার দন্ডের চারদিকে সুপার এনামেল তামার তার প্যাচানো হলো। উক্ত তারের দুই প্রান্তের আড়াআড়ি একটি ব্যাটারি (B) সংযোগ করা হয়েছে। এ তারের সাথে একটি পরিবর্তনশীল রেজিস্ট্যান্স (Rh) একটি সুইচ (k) ব্যাটারির পজেটিভ টার্মিনালের সাথে সিরিজে সংযোগ করা হলো যাতে, কয়েলের প্রবাহিত কারেন্টকে সুইচের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এখন সুইচ অন করলে লোহার দন্ডের উপর প্যাচানো কয়েলের মধ্য দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হবে, ফলে লোহার দন্ডটি চুম্বকে পরিণত হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সার্কিটে কারেন্ট প্রবাহিত হতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত লোহার দন্ডটি চুম্বক থাকবে। আর সুইচটি অফ করার সাথে সাথ লোহার দন্ডটি চুম্বকত্ব হারিয়ে ফেলবে।
লোহার দন্ডটি ইস্পাত অথবা শংকর ধাতুর তৈরি হলে সুইচটি অফ করলে কারেন্ট চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু লোহার দন্ডটি সবটুকু চুম্বকত্ব হারাবে না। কিছুটা চুম্বকত্ব থেকে যাবে। এ থেকে পাওয়া কিছুটা চুম্বকত্বকে অবশিষ্ট চুম্বকত্ব বলে। এভাবে একটি লোহার দন্ডকে চুম্বকে পরিণত করা যায়।
চৌম্বক পদার্থ ও অ- চুম্বক পদার্থ
চৌম্বক পদার্থ : যে সকল পদার্থ চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাহায্যে কৃত্রিমভাবে চুম্বকে পরিণত করা যায় তাকে চৌম্বক পদার্থ বলে। যথাঃ কাচা লোহা, ইস্পাত, নিকেল প্রভৃতি চৌম্বক পদার্থ । পৃথিবীতে চৌম্বক পদার্থের সংখ্যা সীমিত। চৌম্বক পদার্থ তিন প্রকার। যথা-
(ক) প্যারা- ম্যাগনেটিক পদার্থ বা প্যারা চৌম্বকীয় পদার্থ : যে সকল চৌম্বক পদার্থ চুম্বকের প্রভাবে খুব কম বা নগণ্য পরিমাণ আকর্ষিত হয় তাকে প্যারা- ম্যাগনেটিক পদার্থ বলে। যেমন: অ্যালুমিনিয়াম, প্লাটিনাম ইত্যাদি প্যারা- ম্যাগনেটিক পদার্থের উদাহরণ।
(খ) ডায়া- ম্যাগনেটিক পদার্থ: যে সকল চৌম্বক পদার্থ চুম্বকের প্রভাবে বিকর্ষিত হয় তাকে ডায়া- ম্যাগনেটিক পদার্থ বলে। যেমন: দস্তা, পারদ, স্বর্ণ, সীসা, টিন ইত্যাদি ডায়া- ম্যাগনেটিক পদার্থের উদাহরণ।
(গ) ফেরো- ম্যাগনেটিক পদার্থ: যে সকল চৌম্বক পদার্থ চুম্বকের প্রভাবে খুব বেশি আকর্ষিত হয় তাকে ফেরো-ম্যাগনেটিক পদার্থ বলে। যেমন: লোহা, ইস্পাত, কোবাল্ট ইত্যাদি ফেরো- ম্যাগনেটিক পদার্থের উদাহরণ।
অ-চৌম্বক পদার্থ : যে সকল পদার্থ চু্ম্বকের দ্বারা আকর্ষিত ও বিকর্ষিত হয় না এবং যাদেরকে চুম্বকে পরিণত করা যায় না তাকে অ- চৌম্বক পদার্থ বলে। যেমন: কাচ, পানি, তামা, পিতল ইত্যাদি।
ইলেকট্রো- ম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন
ফ্যারাডের ইলেকট্রো – ম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন সূত্র বিবৃতকরণ
ইংরেজ রসায়নবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩১ সালে সর্বপ্রথম চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করা যায় তা আবিষ্কার করেন। তাই একে ইলেক্ট্রো – ম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় আবেশ বলে। তিনি প্রমাণ করেন যে, যখন কোনো পরিবাহী তার চৌম্বক বলরেখাকে কর্তন করে তখন ঐ পরিবাহী তারে ইলেকট্রোমোটিভ ফোর্স উৎপন্ন হয়। এছাড়াও তিনি প্রমাণ করেন যে, ইলেকট্রোমোটিভ ফোর্সের পরিমাণ ম্যাগনেটিক ফ্লাক্স যে হারে পরিবর্তন হয় এটির সমানুপাতিক। উক্ত কথাগুলো ফ্যারাডে প্রথম আবিষ্কার করেন বলেই সূত্রগুলোকে ফ্যারাডের ইলেকট্রো- ম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন সূত্র বলে।
প্রথম সূত্র: যদি একটি তার বা কয়েলে ইলেকট্রোমোটিভ ফোর্স আবেশিত হয়, তখন উক্ত তারের সাথে সংযুক্ত ফ্লাক্সের পরিবর্তন ঘটে।
দ্বিতীয় সূত্র: আবিষ্ট ইলেকট্রোমোটিভ ফোর্স সরাসরি ফ্লাক্সের পরিবর্তন হারের সমানুপাতিক।
লেঞ্জের সূত্র বিবৃতিকরণ
লেঞ্জের সূত্র: সকল ক্ষেত্রে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনে উৎপাদিত ই.এম.এফ এর বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক এমন হয় যে, যাকে নিয়ে এটির উৎপত্তি তাকেই বাধা দিয়ে বসে। যেখানে পরিবাহী স্থির এবং চৌম্বকক্ষেত্র গতিতে থাকে, সেখানে লেঞ্জের সূত্র ব্যবহার করা হয়।
No comments