Monday, May 31, 2021

অধ্যায় ৪ : বিদ্যুৎ

 অধ্যায় ৪ : বিদ্যুৎ (Electricity)

স্বাভাবিক অবস্থায় পরমাণুতে যত সংখ্যক ইলেকট্রন থাকে ঠিক তত সংখ্যক প্রোটন থাকে। বল প্রয়োগ করে পরমাণু থেকে ইলেকট্রন অপসারণ করা যায়। যখন কোন পরমাণু ইলেকট্রন ত্যাগ করে সেই পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন পরমাণুটি ধনাত্মক চার্জে চার্জিত হয়। আবার যখন কোন পরমাণু সেই ইলেকট্রন গ্রহণ করে তখন পরমাণুটি ঋণাত্মক চার্জে চার্জিত হয়।পরমাণুর এই অতিরিক্ত ইলেকট্রন শক্তির সাহায্যে প্রবাহিত করা যায়। পদার্থের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন এর প্রবাহকে বিদ্যুৎ বলে।

গ্রীক শব্দ Elektron হতে বিদ্যুৎ বা ইলেক্ট্রিসিটি শব্দের উৎপত্তি। ইলেকট্রন শব্দের অর্থ সোলেমানী পাথর বা অ্যাম্বার। ৬০০ সালে মি. থেলস লক্ষ্য করেন যে, অ্যাম্বারকে রেশমী কাপড় দিয়ে ঘষলে এর ভিতরে এক অদ্ভুত ধরনের শক্তির উদ্ভব হয়। তখন এই অ্যাম্বার ছোট ছোট কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করে। আসলে এই অদৃশ্য শক্তিই বিদ্যুৎ বা ইলেক্ট্রিসিটি। 


ইলেক্ট্রিক কারেন্ট ( বৈদ্যুতিক কারেন্ট)

কোন বৈদ্যুতিক বর্তনীতে পরিবাহীর মধ্যদিয়ে একক সময়ে যে পরিমাণে ইলেকট্রন প্রবাহকে বৈদ্যুতিক কারেন্ট বলে।

অন্যভাবে বলা যায় কোন কোন পরিবাহীর প্রস্থচ্ছেদের মধ্য দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ চার্জ পরিবাহিতা হয় তাকে বৈদ্যুতিক কারেন্ট বলে।

একে I দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এর একক অ্যাম্পিয়ার।অ্যামিটার যন্ত্রের সাহায্যে অ্যাম্পিয়ার মাপা হয়।

ভোল্টেজ 

কোন নলের ভিতর দিয়ে পানি অথবা গ্যাস পাঠাতে যেমন চাপের প্রয়োজন হয়। তেমনি কোন বর্তনীর তারের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহিত করার জন্য ঐ  রকম চাপের দরকার হয়। পরিবাহী ইলেকট্রন প্রবাহের জন্য যে চাপ দেয়া হয়, সে চাপকে ভোল্টেজ বলে। এই চাপের প্রকৃত নাম ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স।

অর্থাৎ পটেনশিয়াল পার্থক্যকে তড়িৎ চাপ বা  ভোল্টেজ বলে।

একে V দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এর ব্যবহারিক একক ভোল্ট। 

রেজিস্ট্যান্স 

পরিবাহীর মধ্যদিয়ে কারেন্ট প্রবাহের সময় যে বাধা তাকে রেজিস্ট্যান্স বা  রোধ বা প্রতিবন্ধকতা বলে।

অন্যভাবে বলা যায়, পরিবাহীর মধ্যদিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হ‌ওয়ার সময় পরিবাহীর যে ধর্ম বা গুনের জন্য কারেন্ট প্রাবাহ বাধাগ্রস্ত হয় তাকে রেজিস্ট্যান্স বা রোধ বা প্রতিবন্ধকতা বলে।

একে R দ্বারা প্রকাশ করা হয়।এর ব্যবহারিক একক হলো ওহম।

রেজিস্ট্যান্সের সূত্র

পরিবাহীর তাপমাত্রা, উপাদান ও প্রস্থচ্ছেদ বিবেচনায় না নিলে পরিবাহীর দৈর্ঘ্য তার রেজিস্ট্যান্স এর সমানুপাতিক।

পরিবাহীর তাপমাত্রা, উপাদান ও দৈর্ঘ্য বিবেচনায় না নিলে পরিবাহীর প্রস্থচ্ছেদ পরিবাহীর উল্টানুপাতিক বা ব্যাস্তানুপাতিক।

ওহমের সূত্র

অধ্যাপক বিজ্ঞানী ওহম ১৮২৬ সালে সর্বপ্রথম কারেন্ট, ভোল্টেজ ও রেজিস্ট্যান্স এর মধ্যে একটি গাণিতিক সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। তার নাম অনুসারে এই সূত্রকে ওহমের সূত্র বলা হয়।

এ সূত্রের সাহায্যে কারেন্ট নির্ণয় করে তারের সাইজ জানা যায়। তাপমাত্রা বিবেচনায় না আনলে, ওহমের সূত্রের তিনটি রাশির যেকোন দুটি রাশির মান জানলে অপর রাশি সম্পর্কে জানা যায়। বিদ্যুৎ প্রযুক্তিতে এই সূত্রটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এজন্য  বলা হয় Ohm's all is the mother of all law.

চল বিদ্যুৎ

যদি দুটি ভিন্ন বিভব বা পটেনশিয়াল এর মাঝে পার্থক্য থাকে তাহলে যেটার পটেনশিয়াল বেশি সেখান থেকে যেটার পটেনশিয়াল কম সেখানে চার্জ বা অধান প্রবাহিত হয়।যতক্ষন পর্যন্ত দুটি পটেনশিয়াল সমান‌ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রবাহ চলতে থাকে।

চার্জের এই প্রবাহ বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহ । এই বিদ্যুৎ প্রবাহকে অনেকে কারেন্ট বলে।

তড়িৎ চালক শক্তি ও বিভব পার্থক্য

পটেনশিয়াল বা বিভব পার্থক্য বজায় থাকলেই বিদ্যুৎ প্রবাহ ঘটে। তাই বিদ্যুৎ প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন রাখতে চাইলে এই পটেনশিয়ালের পার্থক্য বজায় রাখতে হবে।

যদি দুটি ধাতব গোলককের একটির মাঝে ধনাত্মক চার্জ দিয়ে সেখানে একটি পটেনশিয়াল তৈরি করে চার্জবিহীন অন্য গোলকের সাথে  একটি তার জুড়ে দেই। তাহলে বিদ্যুৎ প্রবাহ শুরু হ‌ওয়ার সাথে সাথে পটেনশিয়াল বা বিভব পার্থক্য কমতে থাকবে। কিছু সময় পর বিভব পার্থক্য সমান হয়ে যাবে।

বিদ্যুতের উৎস

ব্যাটারি , জেনারেটর হতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।ব্যাটারী সেলের ভিতর রাসায়নিক বিক্রিয়া করে পটেনশিয়ালের পার্থক্য তৈরি করা হয়।সেখান থেকে চার্জ প্রবাহিত হলে রাসায়নিক দ্রব্যগুলো খরচ হতে থাকে।যখন রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে চার্জ শেষ হয়ে যায় তখন বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।আমরা সাধারণত যে ব্যাটারীগুলো দেখি তার বিভব পার্থক্য ১.৫ ভোল্ট।

যদি কোন ব্যাটারীতে  Q চার্জকে কম পটেনশিয়াল থেকে বেশি পটেনশিয়ালে আনতে  W পরিমাণ কাজ করতে হয় তাহলে ঐ ব্যাটারী সেলের তড়িৎ চালক শক্তি বা ই এম এফ হচ্ছে


EMF =   W/Q

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, চার্জের প্রবাহ হয় কম পটেনশিয়াল থেকে বেশি পটেনশিয়ালে। আবার বিদ্যুতের প্রবাহ হয় বেশি পেটেনশিয়াল থেকে কম পটেনশিয়ালে।

কোন ব্যাটারী যখন সার্কিটে লাগানো হয় তখন এই তড়িৎ চালক শক্তি‌ই চার্জকে পুরো সার্কিট ঘুরিয়ে আনে। একটি ব্যাটারী যে পরিমাণ পটেনশিয়াল তৈরি করে সেটিই হচ্ছে তড়িৎচালক শক্তি।

বৈদ্যুতিক সার্কিট

বিদ্যুৎ কোন উৎস থেকে বেড় হয়ে যে পথ‌ অতিক্রম করে পুনরায় সে উৎসের মধ্যে ফিরে আসে বিদ্যুৎ চলাচলের সম্পূর্ণ পথকে বৈদ্যুতিক সার্কিট বলে।

একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে তিনটি মৌলিক উপাদান লাগে। 

১. ভোল্টেজ উৎস

২. বৈদ্যুতিক লোড

৩. বৈদ্যুতিক লোড পরিবহনের জন্য তার।


ক্যাপাসিটর

ক্যাপাসিটর বা ধারক শব্দের অর্থ ধারণকারী। যে‌ বস্তু চার্জ ধরে রাখতে পারে তাকে ক্যাপাসিটর বলে। 

যদি কোন পরিবাহীর ভোল্টেজ কমানো যায় তাহলে পরিবাহী টি আর‌ও বেশি চার্জ ধরে রাখতে পারে। যে যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কোন পরিবাহীর চার্জ ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায় তাকে ক্যাপাসিটর বলে।

অন্যভাবে বলা যায় দুটি প্যারালাল পরিবাহীর মাঝে কোন অপরিবাহী পদার্থ দ্বারা পৃথক করলে যে যান্ত্রিক ডিভাইস তৈরি হয় তাকে ক্যাপাসিটর বলে।

একে সি দ্বারা প্রকাশ করা হয়।এর একক ফ্যারাড।

ক্যাপাসিটরের আলাদা দুটি পাতকে ইলেক্ট্রোড বা প্লেট এবং অপরিবাহী পদার্থটিকে ডাই ইলেক্ট্রিক বলে।

ক্যাপাসিটরের ব্যবহার

ক্যাপাসিটরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হলো এসি কারেন্টকে বাধা দেয় এবং ফিল্টার করে ডিসি কারেন্টকে প্রবাহিত করে।

বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ

যে সকল পদার্থের মধ্যদিয়ে বিদ্যুৎ খুব সহজেই প্রবাহিত হয়, কোন বিশেষ বাধার সম্মুখীন হয় না এই ধরনের পদার্থকে পরিবাহী পদার্থ বলে।

সাধারণত সব ধাতুই কম- বেশি ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী। তার মধ্যে তামা, রুপা, অ্যালুমিনিয়াম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


পরিবাহী, অর্ধপরিবাহী, অপরিবাহী

বিদ্যুৎ হলো ইলেকট্রনের প্রবাহ। মে সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে তাপ বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রন পরিবাহিত হয় তাদেরকে পরিবাহী বলে। 

ধাতব পরমাণুর কিছু ইলেকট্রন মুক্ত অবস্থায় থাকে। সেগুলো এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে। সেজন্য ধাতব পদার্থ গুলো পরিবাহী পদার্থ।


যে পদার্থের ভিতর তড়িৎ বা বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য মুক্ত ইলেকট্রন নেই তারা অপরিবাহী পদার্থ।ধাতু বা ধাতব পদার্থগুলো পরিবাহী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অধাতুগুলো বেশিরভাগই অপরিবাহী পদার্থ।তবে গ্রাফাইট বা পেন্সিলের শিশ অধাতু হলেও বিদ্যুৎ পরিবহন করে। পেন্সিলে,ব্যাটারীতে গ্রাফাইট ব্যবহৃত হয়। 

প্লাস্টিক গ্লাস রাবার বিদ্যুৎ পরিবহন করে না তাই এরা অপরিবাহী পদার্থ।

সিলিকন, জার্মেনিয়াম, গ্যালিয়াম । এই পদার্থগুলো নিম্ন তাপমাত্রায় খুব কম বিদ্যুৎ পরিবহন করে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুৎ পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এইজন্য এই পদার্থগুলোকে অর্ধ পরিবাহী পদার্থ।


বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক

পজেটিভ চার্জ সম্পর্কে ধারণা

ইলেকট্রন এর অভাব হলো পজেটিভ চার্জ। তাই ইলেকট্রন সরিয়ে অভাব আরো বাড়িয়ে দেওয়া মানে পজেটিভ চার্জ সরবরাহ করা।

পজেটিভ চার্জ যাওয়া অর্থ ইলেকট্রনকে আসার জন্য দা‌ওয়াত দে‌ওয়া।

A বস্তু থেকে B বস্তুতে পজেটিভ চার্জ যা‌ওয়ার অর্থ  B বস্তু থেকে A বস্তুতে ইলেকট্রন যা‌ওয়া।


বিদ্যুৎ প্রবাহ

চার্জ বা আধানের প্রবাহ হলো বিদ্যুৎ প্রবাহ। সময়ের সাথে চার্জের প্রবাহের হারকে বিদ্যুৎ প্রবাহ বলে। কোন বস্তু থেকে t সময়ে Q পরিমাণ চার্জ প্রবাহিত হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের হার = Q/t

চার্জের একক কুলম্ব ও সময়ের একক সেকেন্ড হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের একক এম্পিয়ার।A বস্তু থেকে B বস্তুতে পজেটিভ চার্জ যা‌ওয়ার অর্থ  B বস্তু থেকে A বস্তুতে ইলেকট্রন যা‌ওয়া।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পজেটিভ চার্জের প্রবাহকে বিদ্যুৎ প্রবাহ বলে।আর ইলেকট্রন প্রবাহিত হয় তার উল্টো দিকে।

প্রবাহ অনুসারে বিদ্যুৎ আবার দুই প্রকার। যথা : এসি বিদ্যুৎ ও ডিসি বিদ্যুৎ।

(ক) ডিসি কারেন্ট : যে কারেন্ট মান ও দিক অপরিবর্তিত রেখে সার্কিটে প্রবাহিত হয় তাকে ডিসি কারেন্ট বা ডাইরেক্ট কারেন্ট বলে।

(খ) এসি কারেন্ট : যে কারেন্টের মান ও দিক সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে সার্কিটে প্রবাহিত হয় তাকে এসি কারেন্ট বলে।

তড়িৎ ক্ষমতা

পটেনশিয়াল প্রয়োগ করে চার্জকে সরানো হলে কাজ করা হয় বা শক্তি ক্ষয় হয়। যদি একটি সার্কিটে V বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করে Q চার্জকে সরানো হয় তাহলে কাজের পরিমাণ বা শক্তি প্রয়োগের পরিমাণ

W = V Q joule 

ক্ষমতা 

P হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে কাজ করার ক্ষমতা ।

যদি t সময়ে Q চার্জ সরানো হয়ে থাকে তাহলে

P = W/t = VQ/t =VI

P = I2R ( V = IR)

বিদ্যুৎ আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস



No comments:

Post a Comment